১. শৈত্যপ্রবাহের সময় বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢেকে দিতে হবে। তবে, দীর্ঘসময় ধরে শৈত্যপ্রবাহ চলতে থাকলে সেখানে দিনে এবং রাতে সবসময় পলিথিন দিয়ে চারা ঢেকে রাখতে হবে এবং বীজতলার উভয়পার্শ্বে পলিথিন আংশিক খোলা রাখতে হবে
২. বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর অপেক্ষাকৃত ভালো জমি হতে প্রতি গোছা থেকে ২-৩টি কুশি আলাদা করে নতুন জমিতে রোপণ করা যায়। এভাবে মূল জমির সমপরিমাণ বা তার চেয়ে অধিক জমিতে চারা রোপণ করা যায় এবং ফলনও মূল জমির মত পাওয়া যায়।
৩. চারা রোপণ যন্ত্রে (মেকানিক্যাল রাইস ট্রান্সপ্লান্টার) ব্যবহারের জন্য ট্রেতে উন্নতমানের ধানের চারা তৈরির লক্ষ্যে বোরো মৌসুমে ট্রে মিডিয়া হিসেবে ২৫% ধানের কুঁড়া + ৭৫% দোআঁশ মাটি ব্যবহার করে স্বাস্থ্যকর চারা উৎপাদন করা যায়।
৪. বোরো মৌসুমে ২০-২৫ দিন এবং আমন মৌসুমে ১৫-১৬ দিন বয়সের, ১২-১৫ সেন্টিমিটার উচ্চতা বিশিষ্ট ধানের চারা যান্ত্রিক রোপণ যন্ত্রে ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।
৫. বন্যাকবলিত অবস্থায় ভাসমান বীজতলায় চারা উৎপাদন একটি অন্যতম বিকল্প পদ্ধতি। বাঁশের/কলার ভেলায় ২-৩ সেন্টিমিটার মাটির আস্তরের উপরে বীজ বপন করে ২০-২৫ দিনের মধ্যে মানসম্পন্ন ধানের চারা তৈরি করা যায়।
৬. আমন মৌসুমের চারা রোপণের জন্য উপযুক্ত সময় হলো মধ্য জুলাই থেকে আগস্টের মাঝামাঝি সময়। বন্যা পরবর্তী সময়ে আলোক সংবেদনশীল জাত সমূহ সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত রোপণ করা যেতে পারে। বোরো মৌসুমে, ধানের চারা রোপণ জানুয়ারি মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা প্রয়োজন, তবে মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের শীতপ্রবণ উত্তরাঞ্চলে ধানের চারা রোপণ করেও ভালো ফলন পাওয়া যায়।
৭. বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলে স্বল্প জীবনকালীন ধানের জাত (যেমনঃ ব্রি ধান৩৩) আগাম রোপণ (জুলাই মাসে) করে সঠিক শস্য বাবস্থাপনার মাধ্যমে মঙ্গা সমস্যার সমাধান করা হয়। এটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখে এবং কৃষিতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ডঃ এম এ মজিদ ২০১৮ সালে জাতীয় স্বাধীনতা পদক লাভ করেন।
৮. কৃষিতত্ত্ব বিভাগ ১৯৭৫ সালে সর্বপ্রথম ধানের জমিতে গন্ধকের ঘাটতি জনিত সমস্যাটি দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে চিহ্নিত করে। জমির গন্ধকের ঘাটতি পূরণের সহজলভ্য সমাধান হিসাবে মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে জিপসাম সার ব্যবহারের সুপারিশ করে।
৯. ব্রি ধান২৯ ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে (DWSR) পর্যায়ক্রমে শুকানো ও ভিজা পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করে এবং হেক্টর প্রতি ১৫০-১৬০ কেজি নাইট্রোজেন প্রয়োগ করে সর্বাধিক ফলন (৭.১-৭.৪ টন/হে.) পাওয়া যায়।
১০. ধানের উচ্চ ফলন নিশ্চিতের জন্য তাজা মুরগির বিষ্ঠার সাথে মৃত্তিকা পরীক্ষার মাধ্যমে বাকি রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা যায়। আমন এবং বোরো মওসুমে যথাক্রমে হেক্টর প্রতি ২.৫ এবং ৩.৫ টন তাজা মুরগির বিষ্ঠা এবং রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে ধানের কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যায়।
১১. সুষম সার ব্যবহারের জন্য বোরো এবং আমন মৌসুমে পর্যায়ক্রমে প্রায় ২.৪ গ্রাম ওজনের ২টি এবং ৩.৪ গ্রাম ওজনের ১ টি এনপিকে ব্রিকেট প্রয়োগে ধানের ফলন এবং সার ব্যবহার দক্ষতা বৃদ্ধি করে।
১২. বন্যা সহনশীল জাতসমূহ বিশেষকরে ব্রি ধান৫১ এবং ব্রি ধান৫২ বন্যার পানি সরে যাওয়ার ৫-১৫ দিন পর হেক্টর প্রতি ৩০ কেজি নাইট্রোজেন এবং ৩০ কেজি পটাশিয়াম সার প্রয়োগ করলে রংপুর অঞ্চলে প্রতি হেক্টর জমিতে ১.০-১.৫ টন অধিক ফলন দেয়।
১৩. বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে পিট মাটিতে ধান চাষের জন্য টিএসপি সহ অন্যান্য সারের প্রয়োজনীয়তার মাত্রা মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে নির্ধারণ করলে ধানের অধিক ফলন নিশ্চিত করা যায়।
১৪. আমন মৌসুমে ধানের জমিতে আগাছার ক্রান্তিক ঘনত্ব (Critical density) নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে আগাছার শুকনো পদার্থের ওজন প্রতি বর্গমিটারে ১১.৯২ গ্রাম বা প্রতি বর্গমিটারে ৯টি আগাছা (ঘাস, সেজ বা প্রশস্ত পাতা বিশিষ্ট) হতে পারে।
১৫. ধানের আগাছা দমনের লক্ষ্যে আগাছানাশকের কার্যকারিতা ও সঠিক মাত্রা নির্ধারণের জন্য কৃষিতত্ত্ব বিভাগ বেশ কিছু আগাছানাশকের সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রি-ইমারজেন্স হিসাবে মেফিনিসেট + বেনসালফুরান মিথাইল, বেনসালফুরান মিথাইল + এসিটাক্লোর; এবং পোস্ট-ইমারজেন্স হিসাবে পাইরাজোসালফুরান ইথাইল, ফেনাক্সোলাম, বিসপাইরিব্যাক সোডিয়াম এসসি অত্যন্ত কার্যকারী। অপরদিকে, উঁচু জমিতে ধানের আগাছা নিয়ন্ত্রণের পেনডিমিথালিন, অক্সাডাআরজিল, অক্সাডায়াজোন আগাছানাশক অত্যন্ত কার্যকর।
১৬. এক ফসলী জমি চাষের পূর্বে জলজ আগাছা পরিস্কারের জন্য আগাছানাশক হিসাবে প্যারাকুয়েট, গ্লাইফোসেট প্রয়োগ অত্যন্ত কার্যকর ও অর্থ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি।
১৭. বাংলাদেশের দক্ষিণ জোয়ার ভাঁটা অঞ্চলের স্থানীয় জাতের ধান চাষের কাঁইচথোড় পর্যায়ে এক বার গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে হেক্টর প্রতি ০.৫ টন অধিক ফলন পাওয়া যায়।
১৮. উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় বোরো মওসুমে ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান৬৭ চাষাবাদে গোছা প্রতি ৩-৪ টি চারা ২০ সেমি লাইনে ২০ সেমি দূরে দূরে রোপণ করলে সর্বাধিক ফলন পাওয়া যায়।
১৯. বোরো মৌসুমে চারা রোপণ যন্ত্র ব্যবহার করে দীর্ঘ জীবনকাল বিশিষ্ট ধান চাষে হেক্টর প্রতি ৩০০ কেজি ইউরিয়া সার চার কিস্তিতে (রোপণের ২০, ৪০, ৬০, ৮০ দিন পর) প্রয়োগ করে ধানের ৬.৫-৭.৩ টন ফলন নিশ্চিত করা যায়।
২০. রংপুর অঞ্চলে খরা সহনশীল স্বল্প জীবনকালীন আমন ধান চাষের জন্য জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে ২৫ দিন বয়সের চারা ২০ × ১৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ এবং যেকোনো একটি প্রি-ইমারজেন্স বা পোস্ট-ইমারজেন্স অথবা ক্ষেত্রবিশেষে উভয় আগাছানাশক প্রয়োগ করে কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যায়।
২১. আউশ ও আমন মওসুমে ৩০-৪০ দিন এবং বোরো মওসুমে ৪০-৫০ দিন জমি আগাছামুক্ত রাখা না হলে যে ক্ষতি হয় পরে সারা মওসুমে ঐ জমি আগাছামুক্ত রেখেও তা পূরণ করা যায় না।
২২. রোপা ধানে কমপক্ষে দু-বার আগাছা দমন করতে হয়। প্রথমবার ধান লাগানোর ১৫ দিন পর এবং পরের বার ৩০-৩৫ দিন পর। জমি শুকিয়ে গেলে বা সেচ দিতে দেরি হলে আগাছার পরিমাণ বেড়ে যায়। বোরো মওসুমে ৪৫-৫০ দিন পর আরেকটি হাত নিড়ানির প্রয়োজন পড়ে।
২৩. বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে রবি- পাট- সাথি ফসল হিসেবে বোনা আমন চাষে স্থানীয় আমন জাতের পরিবর্তে ব্রি ধান৫৬ এবং ব্রি ধান৬৬ হেক্টর প্রতি প্রায় ১.৮-২.২ টন অধিক ফলন পাওয়া যায়। পরবর্তীতে পাট কাটার সময় আমন ধানে সঠিক ভাবে সারের উপরি প্রয়োগ এবং আগাছা বাছাই করা প্রয়োজন।
২৪. ধানক্ষেতে সমন্বিত ধান ও হাঁস চাষাবাদ ধানের আগাছা দমনে একটি লাগসই প্রযুক্তি। এই পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপনের দুই সপ্তাহ পর থেকে সেই জমিতে ২০-৩০ দিন বয়সী হাঁস ছেড়ে দিতে হবে, যা ধান ক্ষেতে অন্যান্য আগাছা খেয়ে ফেলে। এছাড়াও, হাঁসের বিষ্ঠা মাটির ঊর্বরতা বৃদ্ধি করে এবং রাসায়নিক সার কম পরিমাণে ব্যবহার করতে হয়।
২৫. রংপুর অঞ্চলের মাঝারি উঁচু জমিতে প্রচলিত আলু-ভুট্টা-রোপা আমন/ বোরো-পতিত-রোপা আমন শস্যক্রমের পরিবর্তে আলু-মুগ-রোপা আউশ-রোপা আমন শস্যক্রম অনুশীলন করলে কৃষকগন অধিক লাভবান হবেন এবং জমির উর্বরতা ঠিক থাকে।
২৬. চার ফসলভিত্তিক শস্য বিন্যাসে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার গবেষণাটি ব্রি ফার্ম গাজীপুরে চলমান আছে। লিগিউম ফসল মুগ থাকায় এবং উপযুক্ত কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োগের কারণে মাটির স্বাস্থ্য ভাল থাকে। বছরে ৪টি ফসল করার পরও মাটির উবর্রতা কমে নাই; বরং কয়েকটি পুষ্টি উপাদান বেড়েছে। এছাড়া মাটির উপকারী অনুজীব যেমন নাইট্রোজেন ফিক্সিং ও ফসফেট সলিউবল ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক পপুলেশন বোরো-আমন ক্রপিং প্যাটার্ন-এর তুলনায় চার ফসলভিত্তিক শস্য বিন্যাসে প্রায় ৪-৫ গুন বেড়েছে।