১। আমন ধান উৎপাদনে সম্পূরক সেচ
আমন মৌসুমে সাধারনতঃ অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে বৃষ্টিপাত প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় ৬ সেন্টিমিটার গভীরতায় ১-২টি সম্পূরক সেচ দিলে বৃষ্টি নির্ভর উফশী আমন ধানের উৎপাদন প্রায় ৪০%-৪৫% বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত খরা মোকাবেলায় ২/৩ টা সম্পূরক সেচ দিলে হেক্টর প্রতি প্রায় ১ টন উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এছাড়া চারা রোপনের সময় বৃষ্টিপাত না হলে সম্পূরক সেচের মাধ্যমে সময়মত চারা রোপন করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ২৫ জুলাই এর পরে চারা রোপন করলে ফলন কমে যায়। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, আমন ধানের সম্পূরক সেচের আয়-ব্যয় অনুপাত ৩:১।
২। ফার্ম রিজারভার তৈরী করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে খরা মোকাবেলা
কম বৃষ্টিপাত সম্পন্ন এলাকায় আমন ধানের জমির কোনায় ৫% এলাকায় ২ মিটার গভীর করে ফার্ম রিজারভার তৈরী করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষনের মাধ্যমে খরার সময় সম্পূরক সেচ দিয়ে ধানের আশানুরপ ফলন পাওয়া যায়। এ ছাড়া রবি ফসলও সেচের মাধ্যমে করা সম্ভব হয় এবং কিছু মাছও চাষ করা যায়। ফলে ফার্ম রিজার্ভার মাধ্যমে আমন ধান উৎপাদনের আয়- ব্যয় অনুপাত দাড়ায় প্রায় ২:১।
৩। জমির আইল রক্ষনাবেক্ষনের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ
বৃষ্টি হওয়ার পর বৃষ্টিপাতের উল্লেখযোগ্য অংশ অপচয় হয় পানি চুয়ানো ও ভূ-গর্ভে চলে যাওয়া (Seepage and Percolation), আইলের উপরিপ্রবাহ (Overflow) ও পার্শ্বপ্রবাহ (Lateral flow) এর মাধ্যমে। ফলে ফসলের জন্য কার্যকর (Effective) বৃষ্টিপাতের পরিমান দাড়ায় শতকরা ৬০ ভাগে। অথচ, আইল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কার্যকর বৃষ্টিপাতের পরিমান শতকরা ৮০ ভাগে উন্নিত করা সম্ভব। জমিতে যত বেশী বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যায় তত বেশী দিন পানি জমিতে অবস্থান করে এবং তত কম পানির অভাব (Water stress) হবে। ফলস্বরুপ, হালকা বা মাঝারি ধরনের খরা থেকে ফসলকে রক্ষা করতে সম্ভব হয়। তাই, বর্ষা মৌসুমে সাধারণ বৃষ্টিপাত সম্পন্ন এলাকায় জমির আইল ১৫ সেঃমিঃ উচ্চতায় রক্ষনাবেক্ষন করে ৮০ থেকে ৯০% বৃষ্টির পানি সংরক্ষনের মাধ্যমে আমন ধানের কাংক্ষিত ফলন পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে আয় ব্যয়ের হিসাব দাড়ায় ১.২৫:১।
৪। সেচের পানি সাশ্রয়ের মাধ্যমে ধান উৎপাদন
ধান চাষে সর্বদা দাড়ানো পানির প্রয়োজন নেই। ধান ক্ষেতে একবার ৫ থেকে ৭ সেঃ মিঃ সেচ দেয়ার পর জমিতে দাঁড়ানো পানি শেষ হবার ৩ দিন পর পুনরায় সেচ দিলে ২৫% পানির অপচয় রোধ করা যায়।
৫। কমপ্যাক্ট সেচ নালা ব্যবহার
অগভীর নলকুপ এলকায় সনাতন পদ্ধতিতে তৈরী মাটির সেচ নালার তুলনায় কমপ্যাক্ট সেচ নালার মাধ্যমে সেচ দিলে প্রায় ২৫-৩০% পানির অপচয় রোধ করা যায়। এ ছাড়া নালার ভিতরে দুই পাশে কাদা মাটির সাথে তুশ ও গোবর মিশিয়ে প্রলেপ দিলে অধিক কার্যকর হয়। এ পদ্ধতিতে আয় ব্যয়ের হিসাব দাড়ায় ১.৫:১।
৬। হুজ/প্লাস্টিক পাইপ বিতরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সেচ প্রদান
অগভীর নলকুপে হুজ/প্লাস্টিক পাইপ ব্যবহার করে প্রায় ২০% সেচ এলাকা বৃদ্ধি করা যায় এবং সেচের পানির ৮০%-৯০% পরিবহন অপচয় রোধ করা যায়। বেশী পানি ও দূরবর্তী স্থানে পরিবহনের জন্যে হুজ পাইপের টুকরো সংযোজনের ক্ষেত্রে ক্ল্যাম্প পদ্ধতিটি সাধারণ ওভারলেপিং পদ্ধতির চাইতে বেশী উপযোগী। এই পদ্ধতিতে আয় ব্যয়ের হিসাব দাড়ায় ২:১।
৭। পিভিসি পাইপ বিতরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সেচ প্রদান
গভীর নলকুপের পিভিসি পাইপ ব্যবহার করে ৪০%-৫০% সেচ এলাকার বৃদ্ধি করা যায় এবং সেচের পানির প্রায় ৯৯% পরিবহন অপচয়রোধ করা যায়। স্বল্প উঁচু ও নীচু জমিতে সেচ প্রদানের জন্য পদ্ধতিটি অত্যন্ত উপযোগী।
৮। অগভীর নলকুপে সেচের সুবিধার্থে চেক ভাল্ব ব্যবহার
অগভীর নলকুপ চালানোর ক্ষেত্রে প্রতিবার পাম্প চালানোর সময় হস্তচালিত পাম্প দ্বারা ভূগর্ভস্থ পানিকে ডেলিভারী পাইপের মুখ পযন্ত উঠাতে হয় যাকে প্রাইমিং বলে। এটি অত্যন্ত শ্রমসাধ্য কাজ (২-৩ জন লোক লাগে)। সেচ কাজে অগভীর নলকুপ চালনাকে সহজসাধ্য করা ও বিতরণ ব্যবস্থায় প্লাস্টিক পাইপের ব্যবহার সহজতর করার জন্য শ্রমসাশ্রয়ী চেক ভাল্ব উদ্ভাবন করা হয়েছে। অগভীর নলকূপের পাম্পের আগে সাকশন পাইপের সাথে চেক ভাল্বটি স্থাপন করা হয়। পাম্পটি চালু অবস্থায় পূর্বের মতই পানি সরবরাহ করে মূখ পযন্ত পানি ধরে রাখে। ফলে পূনরায় পাম্পটি চালু করলেই পানি সরবরাহ শুরু হয়ে যায়।
৯। লবনাক্ত এলাকায় ভূপৃষ্ঠস্থ পানি ব্যবহার করে বোরো ধান উৎপাদন
নদীর অলবনাক্ত জোয়ারের পানি বাঁধ ও স্লুইচ গেটের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে মধ্য ফেব্রুয়ারি হতে মার্চের শেষ পর্যন্ত বোরো চাষাবাদে সেচ প্রদান করে গড়ে ৪ টন/হেঃ ধান উৎপাদন করা যায়। অন্যথায়, এ সমস্ত এলাকার সেচের পানির অভাবে বোরো মৌসুমে জমি পতিত থাকে।
১০। শুকনো মৌসুমে লবনাক্ততা হ্রাসের মাধ্যমে রবি শস্য উৎপাদন
উপকূলীয় এলাকায় শুকনো মৌসুমে মাটির লবনাক্ততা শস্য উৎপাদনের প্রধান বাধা। মাটি ব্যবস্থাপনা যেমন আমন কাটার পর পরই জমি চাষ এবং উঁচু বেড তৈরীর মাধ্যমে মাটির ৪০%-৬০% লবনাক্ততা হ্রাস করা সম্ভব। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে ফেব্রুয়ারি হতে মে পর্যন্ত রবি শস্য যেমন, তিল, মুগ, সূর্যমুখী ও ভুট্টা চাষ করা যায়।
১১। AWD পানি সাশ্রয়ী পদ্ধতি প্রয়োগে বোরো ধান চাষ
২৫ সেঃমিঃ দৈর্ঘ্য এবং ১০ সেঃমিঃ ব্যাসের, ছিদ্রযুক্ত পিভিসি পাইপ ১৫ সেঃমিঃ মাটির নিচে এবং ১০সেঃমিঃ মাটির উপরে বসাতে হবে। একবার সেচ দেওয়ার পর উক্ত পাইপের পানির স্তর ১৫ সেঃ মিঃ নিচে গেলে আবার সেচ দিতে হয়। এই ভাবে Alternative drying and wetting (AWD) পদ্ধতিতে সেচ দিলে ৫-৬ টি সেচ কম লাগে এবং ২০-৩০% পানি সাশ্রয়ী হয়। তাতে বোরো ধান চাষে তেল খরচ ও শ্রম খরচ কম লাগে। ফলে, হেক্টরপ্রতি ২৫০০-৩০০০ টাকা খরচ কম লাগে।
১২। বরিশাল অঞ্চলের বৃহৎ নদীপ্রবাহসমূহে স্বাদু-লবনাক্ত পানির সীমারেখা নির্ধারণ
জোয়ার-ভাটাপ্রবণ বরিশাল অঞ্চলের চারটি বড় নদীপ্রবাহ, যথাক্রমে, বলেশ্বর, বিষখালী, বুড়িশ্বর এবং তেতুলিয়া-এর বিভিন্ন স্থানে পানির লবনাক্ততা শুষ্ক মওসুমে মার্চ-জুন পর্যন্ত নিয়মিত পরিমাপ করা হয়েছে। নদীর পানি প্রবাহে বিদ্যমান লবনাক্ততার পরিমান ১ ডিএস/মি-এর কম হলে তা স্বাদু পানির সমমান এবং বেশী হলে তা লবনাক্ত পানির সমমান ধরে বলেশ্বর, বিষখালী, বুড়িশ্বর এবং তেতুলিয়া নদীর উজান থেকে উপকূলের নিকটবর্তী এলাকা পর্যন্ত স্বাদু-লবনাক্ত পানির সীমারেখা নির্ধারণ করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেছে, স্বাদু-লবনাক্ত পানির সীমারেখা বলেশ্বর, বিষখালী, বুড়িশ্বর এবং তেতুলিয়া নদীর মোহনা থেকে যথাক্রমে ৩৪ কিমি, ২৪ কিমি, ১৮ কিমি এবং ১৭ কিমি উজানের দিকে বিস্তৃত। নদীর স্বাদু পানি কৃষি জমিতে সেচের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। এই পানি ব্যবহার করে বরিশাল অঞ্চলের আমন মওসুমের পরে যেসব জমি শুষ্ক মওসুমে পতিত পরে থাকে তা চাষের আওতায় আনা যায়। সেচ উপযোগী স্বাদু পানি ব্যবহার করে কৃষকেরা এক ফসলী জমিতে দুই বা ততোধিক ফসল উৎপাদন করতে পারবেন।
১৩। জোয়ার-ভাটা প্রবণ উপকূলীয় অঞ্চলে জলাবদ্ধ ধানক্ষেতে সবজী চাষ
৫০-৭৫ সেমি ব্যাসের পাটের বস্তা ৫০ গ্রাম টিএসপি, ৩০ গ্রাম এমওপি এবং ১ কেজি সরিষা কেক সহযোগে মাটি ভর্তি করা হয় এবং ধানের জমিতে ৩ মিটার দূরত্বে সারিতে স্থাপন করা হয়। মাটি ভর্তি বস্তার মুখ জোয়ারের পানি উপরিভাগ থেকে কমপক্ষে ৩০ সেমি উপরে থাকতে হবে। জনপ্রিয় এবং উচ্চমূল্যের বিভিন্ন সবজী, যেমন, করলা, ঝিঙ্গা, শসা, কুমড়া ইত্যাদি এই বস্তায় চাষ করা যায়। সবজী গাছ বেড়ে উঠার জন্য বাশের খুটিযুক্ত জালের মাচা ব্যবহার করা যেতে পারে। ধানক্ষেতে পাটের বস্তায় সবজীচাষ কৃষকের আয় বৃদ্ধি করে, বেকারত্ব হ্রাস করে এবং সবজীর অব্যবহৃত অংশ (খোসা) জমির কার্বনের পরিমান সমৃদ্ধ করে।
১৪। ভ্রাম্যমান সোলার প্যানেলের মাধ্যমে চালিত ভূ-উপরিস্থ সেচ পাম্পের বহুমুখী ব্যবহার
ভ্রাম্যমান সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে শুষ্ক মওসুমে ফসল উৎপাদনের জন্য ভূ-উপরিস্থ সেচ কাজে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া প্যানেলটি দ্বারা ১.৫ কি.ওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি ওপেন ড্রাম থ্রেসার চালানো যায় যা দ্বারা দুজন শ্রমিক প্রতি ঘন্টায় ২৫০-৩৫০ কেজি ধান মাড়াই করতে পারে এবং ৩-৪টি বসতবাড়িতে ব্যবহার উপযোগী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়।